Sunday, January 16, 2011

বুয়েটের স্টুডেন্টস এডভাইজার কাহিণীঃতৃতীয় এবং শেষ পর্ব

গত পর্বের শেষদিকে লিখেছিলাম, একটি হাসির মর্মার্থ বলবো।ঐবার আমার ফোন পেয়ে স্যার আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।স্যারের কাছে ব্যাপারটার অর্থ ছিল এরকমঃ স্যার আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়েছিলেন এবং ঐ নির্দিষ্ট সময়ে স্যার রুমে ছিলেন না।আমি তাকে ফোন করে রুমে নিয়ে আসি।ব্যাপারটা অনেকটা স্যারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া,যে তিনি নিজেও সময়ানুবর্তী নন।অন্তত স্যারের কাছে ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই মনে হয়েছিল।এবং তার প্রতিশোধ তিনি নিয়েছিলেন, ২ মাস পরেই, সেকথাই এখন বলবো।
গত পর্বের শেষদিকে বলেছিলাম ৩/১ টার্মের রেজিস্ট্রেশনের সময়কার কথা।এই অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের আরেকটি হাস্যকর দিক ছিল, টার্মের মাঝামাঝি সময়ে এডভাইজারের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কপি দেখে সেটি ঠিক আছে কিনা চেক করে সিগনেচার করে আসতে হতো।এই কাজটি করার জন্য প্রতি টার্মের ষষ্ঠ/সপ্তম সপ্তাহে একটি নোটিস দেয়া হতো।এই নোটিস দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এডভাইজারের সাথে দেখা করতে হতো।২/১ আর ২/২ দুটি টার্মে কাজটি ঠিকমতোই করেছিলাম, বিপত্তি দেখা দিল ৩/১ এ গিয়ে।
৩/১ এ ঐ নোটিসটি ঠিক কখন দিয়েছিল টের পাইনি।এমনকি আমার বন্ধুদের প্রায় কেউই টের পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় কেউই সময়মতো তাদের এডভাইজারের সাথে দেখা করেনি।এডভাইজারের সাথে দেখা করার শেষদিন এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম সেদিনই দেখা করার শেষদিন ছিল,তার এডভাইজারের তাকে ফোন করে দেখা করতে বলেছেন।তখনো বুঝতে পারিনি, কত বড় পাপ আমি করেছি।
পরদিন দুরুদুরু বুকে এডভাইজারের সাথে দেখা করতে গেলাম।
স্যারের দরজায় নক করলাম। স্যার ভিতর আসতে বললেনন।কিন্তু না ভিতরে যেতে পারলাম না, দরজায় দাঁড় করিয়েই স্যার আমার সাথে কথা বলা শুরু করলেন।

স্যারঃ তুমি? তুমি কে?
আমিঃ আমি স্যার আপনার এডভাইজি স্যার।
স্যারঃ এক মিনিট।তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছ বলতো? তুমি কি নিজেকে ছাত্র বলতে চাচ্ছ?
আমিঃ জ্বী স্যার, আমি স্যার আপনার ছাত্র।
স্যারঃ আমার ছাত্রতো অনেক পরের ব্যাপার।আগে তুমি বলো তুমি কি আদৌ কোন ছাত্র?তোমার পেশা কি ছাত্রত্ব?
আমিঃ জ্বী স্যার।
স্যারঃ বাজে কথা বলবেনা।সত্যি করে বলতো তোমার পেশা কি? তুমি কি রিকশা চালাও? ঠেলা গাড়ি চালাও? নাকি দর্জির কাজ কর?
আমিঃ না স্যার, আমি ছাত্র।
স্যারঃ তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো তুমি একজন ছাত্র? তুমি? তুমি ছাত্র? শেষ পর্যন্ত এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
আমিঃ জ্বী স্যার, মানে স্যার একটু লেট হয়ে গেল।
স্যারঃ লেট হয়ে গেল মানে?
আমিঃ না মানে স্যার রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারটাতে একটু লেট হয়ে গেল।
স্যারঃ রেজিস্ট্রেশন? তুমি রেজিস্ট্রেশন শব্দের মানে বোঝ? এবার তো আমাকে অবাক হতেই হচ্ছে।বলতো রেজিস্ট্রেশন মানে কি?
আমিঃ সরি স্যার লেট হয়ে গেছে।
স্যারঃ তাহলে তুমি সত্যি বলছো তুমি রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালাও না? তুমি একজন ছাত্র?
আমিঃ জ্বী স্যার।
স্যারঃ তাহলে এবার বলো কি জন্যে এসেছ ।
আমিঃ স্যার রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে দেখা করতে এসেছিলাম।
স্যারঃ রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে দেখা করতে এসেছ? তার মানে তুমি জানতে কবে দেখা করতে হবে?
আমিঃ না স্যার, কালই প্রথম জানতে পেরেছি।
স্যারঃ কোথায় থাকো? হলে না বাসায়?
আমিঃ হলে স্যার।
স্যারঃ হলে থাকো? আচ্ছা এসো, বসো।
বসলাম।
স্যারঃ দেখ তো চারকোনা এই কাগজটা চিনতে পারো কিনা? পারছো চিনতে?
আমিঃ জ্বী স্যার।
স্যারঃ এই কাগজটি তুমি প্রতিদিন যেখানে খেতে যাও, সেখানে দিয়ে দেয়া হয়েছিল তোমার পড়ার জন্য।এটা তোমার চোখে পড়েনি?
আমিঃ না স্যার, ঠিক খেয়াল করিনি।
স্যারঃ তা করবে কি করে? যখন কেউ পরীক্ষা পেছানোর মিছিলের নোটিস দেয়, সেটা চোখে পড়তে তো এক মিনিটও সময় লাগেনা।এখন তুমি এক কাজ কর, পুরো নোটিসটা পড়ে শোনাও, আমি শুনি এখানে কি লেখা আছে।
আমিঃ স্যার মানে স্যার...
স্যারঃ এতো মানে জিজ্ঞেশ করার কি হলো? বাংলা পড়তেও জাননা নাকি? তাহলে বল বুয়েটের ভিসিকে বলে বুয়েট থেকে তোমাকে বিদায় করে দেয়ার ব্যাবস্থা করি।
এরপর কম্পমান হাতে নোটিসটি নিয়ে পড়া শুরু করলাম।
নোটিসের উপরে লিখা ছিল "বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়"।তো ভয়ে নাকি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে জানিনা, আমি পড়ে ফেললাম "বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়"। এরপর স্যারের প্রতিক্রিয়া ছিল এরকমঃ
"বিদ্যালয়? বিদ্যালয়ে পড়ছো তুমি? বুয়েটকে তোমার কাছে বিদ্যালয় মনে হয়?বিদ্যালয়ে কারা পড়ে জানো? কচি শিশুরা।তোমার কি মনে হয় তুমি এখনো কচি শিশু? তুমি কি ডাইনিং এ গিয়ে ভাত না খেয়ে রুমে বসে ফিডার খাও?কচি শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনা, বড়রা তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেন। কচি শিশুরা স্কুলে যাবার সময় তাদের সাথে একটা বিশাল ব্যাগ থাকে, আর থাকে একটা ফিডারের বোতল।এই ফিডারের বোতল সাধারনত শিশুদের সাথে একজন গার্জিয়ান থাকেন, তিনি বহন করেন।তো আমার কি এখন প্রতিদিন সকালে হলে গিয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে হবে? তোমাকে ড্রেসআপ করাতে হবে? তোমার ফিডারের বোতল এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে তোমাকে ধরে বুয়েটে নিয়ে আসতে হবে?"

আমার অবস্থা হলো যাকে বলে কেরোসিন।এরপর নোটিসে আর কি কি লিখা ছিল আমি পুরোপুরি মনে করতে পারছিনা।এটুকু মনে আছে, আমি প্রতিটি লাইন পড়ছিলাম আর স্যার সাথে সাথে অপমানজনক কমেন্ট জুড়ে দিচ্ছিলেন।এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট পরে নোটিস পড়া শেষ হলো।এরপরের কথাগুলো কিছুটা মনে আছে।
স্যারঃকি? শেষ হয়ে গেলো?
আমিঃ জ্বী স্যার, শেষ হয়ে গেলো।
স্যারঃ বই পড়ে তো কিছু বুঝনা তা ভালোই জানি।এই নোটিসটা পড়ে কি বুঝতে পারলে বলতো?নাকি এটা পড়েও কিছুই বুঝতে পারোনি?
আমিঃ স্যার এই নোটিসে আমাদেরকে গতকালকে পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল নিজ নিজ এডভাইজারের সাথে দেখা করার জন্য।
স্যারঃ তো দেখতেই পাচ্ছো গতকালকে পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল তোমাকে।এমনকি আমি আমার কলমের কালি খরচ করে একটা নোটিস লিখে আমার দরজার সামনে টানিয়েও দিয়েছি।সেখানে পরিষ্কার করে লিখে দেয়া আছে কবে কখন আমার সাথে দেখা করতে হবে। তোমার কি ধারনা এসব আমি ফাজলামি করার জন্য করেছি?
আমিঃ না মানে স্যার নোটিসটা ঠিকমতো খেয়াল করিনি।
স্যারঃ খেয়াল করোনি মানে কি? নোটিস কি তোমার চোখে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া উচিত ছিল? নাকি আমার উচিত ছিল তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে নোটিস পড়ে শোনানো? নাকি আমার উচিত ছিল তোমাকে ফোন করা, যে আমার সাথে তোমাকে দেখা করতে হবে?
আমিঃসরি স্যার।
স্যারঃ আমি কি তোমার জন্য সারাজীবন রেজিস্ট্রেশনের কাগজ নিয়ে বসে থাকবো?শিক্ষকদের কি আর কোন কাজ নেই বলে তোমার ধারনা?তারা কি তাদের সব কাজ বাদ দিয়ে তোমার মতো অছাত্র কুছাত্রদের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকবে, কখন তোমাদের মনে দয়া হবে আর তোমরা তাদের কাছে আসবে?

এরকম আরো দুয়েকটি কথা বলার পর স্যার আমাকে এক জায়গায় সিগনেচার করতে বলেন, সিগনেচার করে চলে আসি।

স্যারের রুম থেকে আসার পর ২ ঘন্টা কোন কথা বলতে পারিনি, এবং এরপরের তিনদিন কোন ক্লাসও করিনি, ল্যাবেও যাইনি।

পুনশ্চঃ আমার এডভাইজারের ব্যাবহার এরকম ছিল বলেই মনে করবেন না বুয়েটের প্রতিটি শিক্ষকই তাদের এডভাইজিদের সাথে এমন ব্যাবহার করেন।আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, "দোস্ত, আমি যদি বুয়েট থেকে পাস করে বের হই, তাহলে তাতে আমার চেয়ে আমার এডভাইজারের অবদান মোটেই কম হবেনা।এডভাইজার এতো উৎসাহ না দিলে আমি কোনদিনই বুয়েট থেকে পাস করে বের হতে পারতাম না"।
সুতরাং দোষটা সিস্টেমের নয়, দোষ কিছু শিক্ষকের মনমানসিকতায়।শিক্ষকরা যদি ছাত্রদের গরু ছাগল মনে না করে  মানুষ মনে করেন, তাহলে শিক্ষক তার ছাত্রের সাথে খারাপ ব্যাবহার করলেও তার একটা মাত্রা থাকবে।মানলাম শিক্ষকরা তাদের ব্যাচের সেরা ছাত্র ছিলেন।তার মানে এই নয় যে বুয়েটে অন্যান্য যেসব ছাত্র আসে তারা সবাই গরু ছাগল।সবাই সম্পুর্ণ বিতর্কমুক্ত একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের সব মেধাবী ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই বুয়েটে চান্স পায়, ঘাস বা গাঁজা খেয়ে নয়।

3 comments:

  1. শেষের কথা গুলো ভালো লাগলো, একদিন নিশ্চয় এই ছাত্র-শিক্ষক দন্ধের অবসান হবে, স্বপ্ন দেখতে দোষ কী????

    ReplyDelete
  2. এরকম কুত্তার্মাকা টিচার সবখানেই আছে। এগুলার কথা বাদ দেন পলাশ ভাই। আমাদের গ্লাসে ১০ ভাগের ৯ ভাগ খালি, ১ ভাগ মাত্র পানি। লজিক্যালি আমাদের বলা উচিত, গ্লাসের ৯ ভাগ খালি, কিন্তু আমরা বলবো গ্লাসের ১ ভাগ ভরা।

    একদিন নিশ্চয় আমরা এমন শিক্ষক পাবো যারা পিতার মতো দায়িত্ব নিয়ে ছেলেদের পড়াবে।

    ReplyDelete
  3. @Nahid... স্বপ্ন দেখতে দোষ নাই সত্যি... কিন্তু স্বপ্ন যে বড় বেশি সুদূর পরাহত।
    @Neo: কথা সত্য... আমাদের গ্লাসের ১০ ভাগের ৯ ভাগই আসলে খালি।ঐ ১ ভাগ ভরা নিয়াই আমাদের যত আশাবাদ।
    তবে ভবিষ্যতে শিক্ষক ছাত্রদের পিতামাতার মতো যত্ন নিয়ে পড়াবেন, সে আশা বড়ই দূরাশা।প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অর্থের মানদন্ডে বিবেচিত হচ্ছে... অদূর ভবিষ্যতে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও যে এরকম হবেনা তাই বা কে বলতে পারে।

    দুজনকেই কমেন্টানোর জন্য ধইন্যাপাতা।

    ReplyDelete